Name: Keya (ছদ্মনাম)
Age: 38
Country: Bangladesh
ফোনে রিঙ বেজেই চলেছে।
বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করে কেয়া।
ওপাশ থেকে, চাচীর কণ্ঠস্বর, “তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি।
খুবই ভালো একটা চাকরি করে আর পরিবারের ছোট ছেলে…
চাচী বকবক করতেই থাকে। কেয়া কেবল হু হা করে উত্তর দিতে থাকে। মা পাশে এসে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলে, “আর কতদিন একা থাকবি। কোনো সঙ্গী না থাকলে তো একাকী মরতে হবে জীবনে! যার সাথে কথা বলিস তার সাথে তো আমরা কোনো ভবিষ্যত দেখি না।”
কেয়া হতাশ হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি সুন্দর আকাশ দেখা যাচ্ছে, সেই আকাশে মেঘগুলো যেন গাভীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে।
কেয়া একজন এসেক্সুয়াল। নিজের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন৷ তার উপর তার নিজের বাউন্ডারিতে কাউকে স্থান দিবে এমনটা ভাবতে পারে না। তবে ভয় করে একাকী হয়ে যাওয়ার। কি করে একাকীত্ব ঘোচাবে সে? হটাৎ ই তার মনে হয় একটি বাচ্চা পালক হিসেবে নিয়ে নিলে কেমন হয়?
রাতে কথা হয় জাস্টিন এর সাথে। কারণ জাস্টিন নিজেও একজন এসেক্সুয়াল। কেয়ার সাথে তার দীর্ঘদিনের লং ডিসটেন্স রিলেশনশীপ। তবে জাস্টিনের আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আছে, তার দত্তক কণ্যা লিভিয়া। সে-ই মেয়েকে জাস্টিন একটি অনিবার্য অংশ হিসেবে ধরা যায়। বাচ্চা একটি মেয়ের সুখে সে সুখী হয়, আবার দুঃখে যেন দুঃখী হয়। এক সঙ্গে ছুটির দিনগুলোতে সিনেমা দেখতে যায়, পার্কে যায়, পিকনিকে যায়, তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী , গল্প করে সারাদিন, দিন শেষে ডিনার করে দিন শেষে।
কেয়া আর জাস্টিন পরিচয় এইসদের ডেটিং অ্যাপ ACEapp-Asexual Social Network, এর মাধ্যমে হয়েছিলো। জাস্টিন বায়োতে যে লেখা ছিলো,সেটাই কেয়াকে আকৃষ্ট করেছিলো। তারপর অনেক কথা হয়, একটা পর্যায়ে তাদের মনে হয়, তারা দুজন আসলে দুজনার জন্য ই তৈরি হয়েছে। কিন্তু মাঝখানে স্থানিক বিরাট দূরত্ব। দুজন দুই দেশের বাসিন্দা৷ কেয়ার দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। টোরেসা তাই কেয়ার দেশে আসতে ভয় পায়। মাঝখানে স্থবির সময়ে আসার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু আবার দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। বারাবার এমন অস্থিতিশীলতায়, আসার সম্ভাবনা একদমই কমে গিয়েছে। কেয়া পরিবারের একমাত্র সন্তান, সাথে বৃদ্ধ বাবা মা আছেন৷ তাদের দেখভালের একটি বিষয় আছে, তাই কেয়াও জাস্টিনের দেশে যেতে পারছে না। যদিও এসব বিষয় দুজনকে এত ভাবায় না। যখন প্রয়োজন পড়ে দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছে, ভিডিও কলে দেখতে পারছে একে অপরকে, এটাই বা কম কি। তাও নিজের মনের মতে মানুষ পেয়েছে দুজন।
জাস্টিনকে বাচ্চার কথা বলতেই, অনেক খুশি হয়ে যায়। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলে, “তোমার একাকীত্ব দূর করার জন্য আসলেও একজন মানুষ খুব দরকার। একটি সন্তান যেভাবে সেটা পূরণ করতে পারবে, এমন অন্য কেউ পারবে না। তুমি পালক হিসেবে একজনকে নিতে পারো। আমাদের দুটো সন্তান হবে।”
কেয়া মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক, যার কাছ থেকে সাপোর্ট আশা করে। তার থেকে তা পাওয়া গেলো। এখন অনেকটাই মনে জোর আসে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, ওর ফ্যামিলি মানবে তো। নাকি বেঁকে বসে। সব ভাবনাকে সরিয়ে ঘুমুতে গেলো সে।
তখনি আবার সেই চাচীর ফোন, “ দেখ, কেয়া, ছেলেটা কিন্তু অনেক ভালো। ভাইয়ের অবস্থা ভালো না৷ হুটহাট যেকোনো কিছু হয়ে গেলে, একা যুবতী কন্যা কি করবি তুই?
হড়বড় করে বলতে থাকে চাচী। ওর মনটাও খারাপ হয়ে যায়। আসলেই যদি বাবা মারা যায়। ওঘর থেকে৷ খুকখুক কাশি শোনা যায়। প্রতিটি কাশি নতুন আতঙ্ক নিয়ে আসে। সে কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দেয়। ওঘরে গিয়ে দেখে আসে বাবার অবস্থা। এই রাতও নির্ঘুম কাটে৷ পরেড দিন বেলা করে ঘুমিয়ে তাড়াহুড়ো করে যায়, শিশুর অন্বেষণে।
১৮৭৫ সালের মাইনরিটি অ্যাক্টের ৩ ধারা মোতাবেক ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুর জন্য ১৮৯০ সালের অভিভাবকত্ব ও পোষ্য (গার্ডিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্ডস এ্যাক্ট) আইনের ৭ ধারায় কাস্টডি নেওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালের ফ্যামিলি কোর্ট অর্ডিন্যান্সের অধীনে এখতিয়ারভুক্ত পারিবারিক আদালতে আবেদন করতে হবে।
অবিবাহিত মহিলা যিনি বিয়ে করবেন না বলে ঠিক করেছেন, অথবা বিয়ের বয়সও নেই, কিন্তু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল তিনি পালক সন্তান গ্রহণ করতে পারেন। পালক সন্তান নিতে আগ্রহী পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হতে হবে।
অনাথ বা এতিম শিশু, যে শিশুর পিতা-মাতা ঐ শিশুর প্রতিপালনে অক্ষম, পরিত্যাক্ত শিশু দত্তক হিসেবে গ্রহন করা যাবে।
দত্তক নেওয়ার জন্য, পিতা মাতা থেকে বা সন্তানের অভিভাবকদের থেকে,ছোট মনি নিবাস যেখানে অভিভাবকহিন, পাচার হওয়ার সময় থেকে উদ্ধার বা পরিত্যাক্ত শিশুদের লালন পালনের জন্য গঠিত সংগঠন যার রংপুর এবং ময়মনসিংহ বাদে দেশের ৬ টি বিভাগে ৬ টি শাখা রয়েছে, বিভিন্ন এন.জি.ও এর থেকে বাচ্চা গ্রহন করতে পারবে।
অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশে সরকারের কোনো স্বতন্ত্র দত্তক কর্তৃপক্ষ বা অ্যাডপশন এজেন্সি নেই। কাস্টাডি বিষয়ক সকল এখতিয়ার শুধুমাত্র পারিবারিক আদালতের।
যেই বাচ্চাকে পালক নিতে ইচ্ছুক তার বায়োলজিক্যাল প্যারেন্টস্ বা জন্মদাতা বাবা-মা কেউ যদি জীবিত থাকে, তাহলে একজন আইনজীবীর সাহায্য নিয়ে তাদের কাছ থেকে অনাপত্তি পত্র, অ-প্রত্যাহার যোগ্য হলফ নামা এবং বাচ্চার জন্ম সনদ সংগ্রহ করে নোটারি পাবলিক দিয়ে সত্যায়িত করতে হবে। এর পর ৬০ টাকা বা নির্ধারিত কোর্ট ফি দিয়ে বাচ্চাটি যেই এলাকায় বসবাস করে, সেই এলাকা যে আদালতের স্থানীয় এখতিয়ারের মধ্যে অবস্থিত, সেই পারিবারিক আদালতে বাচ্চাটির অভিবাবকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে।
সরকারি শিশুমনি নিবাস বা হাসপাতাল বা অভিবাবক শূন্য পরিত্যাক্ত শিশুর ক্ষেত্রে সমাজকল্যান মন্ত্রনালয় কে নির্দেশ দিতে পারেন, এর জন্য যে পালক নিতে চায় সে নিতে যোগ্য কি না। আদালত সব কিছু বিবেচনা করে ঠিক মনে করলে অভিবাবক্ত্ব অনুমোদন করবেন।
কেয়া আটকে গেলো শেষ ধাপে। যেহেতু এতিম বা অনাথ কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। সে শিশুমনি নিবাস থেকে বেওয়ারিশ শিশু নিতে চেষ্টা করলো। সেখানে, সে যেহেতু বিবাহিত নয়, তো, কর্মকর্তা তাকে যা বললো তা অনেকটা এরকম, “এইসব বাচ্চাগুলো সাধারণত আমাদের দেশ অনুযায়ী অবৈধ বা জারজ। আমাদের উদ্দেশ্য থাকে, এইসব বাচ্চাগুলোকে পিতার পরিচয় দান করা। কিন্তু আপনার নিকটে যদি আমরা কাস্টডি দেই। তাহলে তো সে পিতার পরিচয় পাবে না। তাই আমরা আপনাকে বাচ্চা হস্তান্তর করতে পারি না।”
কেয়া অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না কিছু করতে। পালক নিতে এত ঝামেলা ওতোসব সে ভাবে নি। সে হতাশ হয়ে পড়লো৷ অনেক সুন্দর ফুটফুটে একটি শিশু তার পছন্দ হয়েছিলো। এভাবে, এই শিশুকে সে হারাতে চান না।
শিশুমনি নিবাস থেকে, এও বলে দিলো। যদি বাইরের দেশের নাগরিকত্ব থাকে তাহলে তারা কিছু করতে পারেন। বাংলাদেশে পিতা ছাড়া সন্তানের যে পরিমাণ মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, নানা কথা শুনতে হয় সেই ভয়াবহতার দিকে আমরা কাউকে ঠেলে দিতে পারি না। কেয়া বললো, বাংলাদেশের বা মুসলিম আইনে তো কোন নিষেধাজ্ঞা নাই, কেন তাহলে বিদেশ যেতে হবে?
উপ-পরিচালক জানালেন, আইন দিয়ে তো সব হয় না, মানুষকে সমাজের মধ্যে বড় হতে হবে, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে আমরা কখনো কোন অবিবাহিত নারীকে সন্তান দত্তক দেই নাই। কারন বাবার নাম ছাড়া বাঙ্গালী সমাজে এ শিশুটিকে জীবনের প্রতিটি ধাপে অপমানিত হতেই হবে। স্কুল কলেজ বিশ্ব বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র – কোন জায়গায় সে হেনস্থার স্বীকার না হয়ে পার হতে পারবে ?
শিশু মনি নিবাসের উপ-পরিচালক যোগ করলেন- পিতৃতান্ত্রীক সমাজে বাবার সার নেইমটাই সব।
এক সমুদ্র বিষন্নতা নিয়ে কেয়া রাজপথে হাটছে আবারো,
এ যেন অফুরন্ত পথ, বুকের ভিতরে ভয়ংকর একটা শূন্যতা যেন গান হয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।