সাক্ষাৎকারদাতা: দীপা মাহবুবা ইয়াসমিন
স্থান: অপ্রকাশিত
সাক্ষাৎকারের তারিখ: ২০২৫
সাক্ষাৎকারগ্রহীতা: অযৌনচিত্ত বাঙ্গালী সংঘ
বিষয়: অযৌন পরিচয়, চিকিৎসা গ্যাসলাইটিং, পারিবারিক চাপ, সমকামী কর্তিত্ববাদ সমালোচনা
ট্যাগ: অযৌনতা, মুসলিম, ঢাকা, অযৌনচিত্ত অভিবাসন, মানসিক সহিংসতা, প্রতিরোধ
পর্ব ১: “এই শব্দটি জানার আগে, আমি নিজেকে চিনতাম”
দীপা:
“তেইশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি ‘অযৌনতা’ শব্দটাই জানতাম না। কিন্তু আমি জানতাম, আমি অন্যদের মতো নই।
আমি লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে ভালোবাসতাম, অনুভব করতাম, কিন্তু তাতে কখনোই শরীর জড়িত ছিল না। আমি দিবাস্বপ্ন দেখতাম, সিনেমার রোমান্সে ডুবে যেতাম, কখনো কখনো কারও প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করতাম—কিন্তু তাতে চুমু, ছোঁয়া, স্পর্শের কোনো তাড়না থাকত না।
চারুকলায় পড়ার সময় এমন একজন পুরুষের ছবি নিয়ে নিরীক্ষা সিরিজ একেঁছিলাম যাকে আমি পছন্দ করতাম, অথচ কোনোদিন তার দিকে হাত বাড়ানোর কথা ভাবিনি। এটা লজ্জা ছিল না, ভয়ও না। এটা ছিল এক ধরনের নিরাবেগ সত্য।”
সাক্ষাৎকারগ্রহীতা:
আপনার অযৌনচিত্ত অভিজ্ঞতার শুরুর কথা মনে আছে?
দীপা:
“এটা কোনো একক মুহূর্ত ছিল না, এটা ছিল ধারাবাহিক একটা অস্বস্তি। সবাই যেন ধরে নিত, আকাঙ্ক্ষা মানেই প্রেম, প্রেম মানেই শরীর।
স্কুলে, কলেজে, বিয়ের গল্প, বয়ফ্রেন্ড, হানিমুন—সবকিছু যেন জীবনের ‘স্বাভাবিক’ মানচিত্রে বাধ্যতামূলক চেকপয়েন্ট।
একদিন আমি একটি ভারতীয় অযৌনচিত্ত কমিউনিটির কথা পড়ি অনলাইনে, সেখানেই প্রথম কলকাতার কিছু মেম্বারদের নিয়ে ‘অযৌন’ শব্দটি দেখি। মুহূর্তটিতে যেন একটা দরজা খুলে গেল। মনে হলো, অবশেষে নিজেকে কোথাও খুঁজে পেলাম।”
পর্ব ২: পরিবার, নীরবতা এবং ধর্মীয় হস্তক্ষেপ
দীপা:
“আমার পরিবার আমাকে কখনো সোজাসুজি কিছু বলেনি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের চাহনি বদলাতে থাকলো।
কখনো কোনো সম্পর্ক নেই, তারপরেও বিয়ে কেন করতে চাও না —তাদের সন্দেহ বাড়ছিল।
এক প্রবাসী চাচী গুজব রটিয়ে দিয়েন পরিবারে যে , আমি লেসবিয়ান ! এবং তিনিই সকলকে বললেন এটার জন্য নাকি বিদেশে চিকিৎসাও আছে ! (এখন ঐসব মূর্খদের কথা ভাবলেও হাস্যকর লাগে আমার)
বন্ধুরাও বলতে শুরু করলো, ‘তুমি কি লেসবিয়ান ? তুমি কি নিশ্চিত তুমি মেয়েদের পছন্দ করো না?’
আমার মা বেশি নামাজ পড়তে শুরু করলেন। এক রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি এমন কেন? আল্লাহ তো তোমাকে এমন বানাননি।’
এরপর শুরু হলো ‘চিকিৎসা’র অধ্যায়।
আমার মা প্রথমে গেলেেন এক হুজুরের কাছে, যিনি পবিত্র পানিপড়া দিয়ে দিলেন , সঙ্গে একটা তাবিজ। তারপর গেলেন ডাক্তারদের কাছে। তারা শারীরিক অর্থাৎ হরমনাল সব রিপোর্ট ক্লিয়ার পেয়ে বললেন—’মানসিক সমস্যা’। তারপর একজন সাইকোলজিস্টের কাছে পাঠানো হলো।”
পর্ব ৩: অযৌনতার রোগবিদ্যা
আর্কাইভিস্ট মন্তব্য:
দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষণশীল সমাজে অযৌনতা প্রায়শই মানসিক রোগ হিসেবে ভুল বোঝা হয়। দীপার অভিজ্ঞতা এ অঞ্চলের অসংখ্য কণ্ঠের প্রতিধ্বনি বহন করে।
দীপা:
“সেই ডাক্তারের নাম এখনও মনে আছে—‘ড. আবদুল্লাহ’।
তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কারো প্রতি আকর্ষণ বোধ না করলে কেমন লাগে?’
আমি বললাম, ‘বিচ্ছিন্ন লাগে। মনে হয় আমি কোনো এক অদৃশ্য ঘেরাটোপে আটকে আছি।’
তিনি বললেন, ‘তোমার গ্যামোফোবিয়া আছে। তুমি ঘনিষ্ঠতা ভয় পাও।’
আমি যখন বললাম, আমি প্রেম চাই, সঙ্গ চেয়েছি, এমনকি পরিবারও—কিন্তু যৌনতা ছাড়া—তিনি হাসলেন। আমার কথায় বিশ্বাস করলেন না। আমার অস্তিত্বই যেন অস্বীকার করলেন।”
পর্ব ৪: জবরদস্তি থেকে বাঁচার গল্প
দীপা:
“এক রাতে মাকে শুনলাম ফোনে বলছেন—আমার জন্য এক প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে।
আমি কিছু বলিনি, কিন্তু জানতাম—যদি এখন না পালাই, তাহলে আমাকে এমন কিছু করতে হবে, যা আমার সত্ত্বার মৃত্যু ঘটাবে।
আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না, চাকরি ছিল না, নিরাপদ ঠিকানাও ছিল না।
ভয়াবহ অনিরাপত্তাকে মেনে নিয়েই বাসা থেকে পালিয়ে গেছিলাম। এক হিজড়া সমবয়সী বন্ধু আমাকে তার ছোট্ট বাসার এক রুম সাবলেটে থাকতে দিলেন।
তার হাত ধরেই আমি প্রথম ঢাকার একটি আন্ডারগ্রাউন্ড কুইয়ার গ্রুপে ঢুকি।
ওই কমিউনিটি আমাকে শুধু আশ্রয় দেয়নি—আমাকে ফের জীবনে টিকিয়ে রেখেছিল।
তবে তারাও এক সময় দূরে ঠেলে দিলো , যখন বুঝলো আমি ট্রান্স বা লেসবিয়ান নই , আমি তাদের বাক্সগুলোর বাহিরে”
বারবার কোণঠাসা হয়ে গেছিলাম এই অপরিচিত সমাজে ।
পর্ব ৫: নীরবতা থেকে বিশ্বমঞ্চে
দীপা:
ঠিক করলাম যেভাবেই হোক , এদেশে নিজের মতো মানুষদের খুঁজে বের করবোই !
“আমি ছোট ছোট ভিডিও বানাতে শুরু করলাম। নিজের ফোনেই।
‘অযৌনতা মানে কী?’ এই প্রশ্নটা নিয়ে অনলাইন মিটিং আয়োজন করে কথা বলতাম চারপাশের অনেকের সাথেই।
প্রথমবারের মতো নিজের মুখে বলেছিলাম—‘যৌন আকাঙ্ক্ষা অনুভব না করা মানে আমি অসম্পূর্ণ নই। আমি শুধু আলাদা। এবং এটাই আমার স্বত্তা , আমার অযৌনচিত্ত , আমার পরিচয়।’
আমি চমকে গিয়েছিলাম—লোকেরা শুনছিল।
BBC বাংলা আমার সাক্ষাৎকার নিল, Voice of America একটা ফিচার করল।
আন্তর্জাতিক অর্গানাইজেশনগুলো যোগাযোগ করতে শুরু করল।
তখনই বুঝলাম—আমি শুধু বেঁচে নেই, আমি ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠছি।”
পর্ব ৬: নামকরণ ও ক্ষমতা
দীপা মাহবুবা ইয়াসমিন:
“আমার গল্পটা আলাদা নয়, বরং খুব সাধারণ। এটাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও দুঃশ্চিন্তার বিষয়।
অনেকেই আছেন—যারা হেটারোনরমেটিভ অযৌন, আবার কেউ কেউ হোমোরোমান্টিক—তারা কোথাও ঠিকঠাক ফিট করে না।
তারা সমকামী পরিচয়ও বহন না, আবার হেটেরোসেক্সুয়ালও নয়— যেহেতু পরিচিত বক্সে তারা ফিট হন না, তাই তাদের কথা বলার জায়গা থাকে না।
আমি বিশ্বাস করি—যে অভিমুখীতা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ মুছে ফেলতে চায়, তা উচ্চারণ করার মধ্যে বিপ্লব আছে।
আমি যখন বলি ‘আমি অযৌনচিত্ত’, তখন আমি শুধু নিজেকে নয়, আরেকজনকে এমনকি এখন গোটা দেশের অযৌনচিত্ত কমিউনিটিকে নিঃশ্বাস নেওয়ার নিরাপদ জায়গা তৈরি করে দিতে পেরেছি।”
আর্কাইভাল টীকাঃ
- সাক্ষাৎকারের ধরন: জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য অনুমতি-সহ বেনামী সংরক্ষণ
- ট্রিগার সতর্কতা: পারিবারিক সহিংসতা, চিকিৎসা গ্যাসলাইটিং, জোরপূর্বক বিয়ে
- ভাষা: সাক্ষাৎকারটি বাংলায় পরিচালিত; ইংরেজিতে অনুবাদে সহায়তা করেছে Queer Oral Histories Working Group
- নথিভুক্তির উদ্দেশ্য: দক্ষিণ এশিয়ায় অযৌন অভিজ্ঞতার নিঃশব্দতা ভাঙা এবং বৈশ্বিক কুইয়ার সংলাপে স্থানীয় কণ্ঠস্বর যুক্ত করা।
I really appreciate the how-to guides you post for tech setup and troubleshooting. They are lifesavers for a non-tech-savvy person like me!
Don\’t hesitate to reach out if you need more help.
I\’m so glad I found your site. Your posts are consistently excellent.
Your dedication to providing quality content is truly admirable. I\’m a fan of your work.
I love how your posts are always so well-structured and easy to follow. Keep it up!